
অবৈধ ইজিবাইকের দাপটে বাড়ছে দূষণ
পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ‘বাঘ’ আসতে বাধা কোথায়
- আপলোড সময় : ০১-০৯-২০২৫ ০৫:০৯:০১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০১-০৯-২০২৫ ০৫:০৯:০১ অপরাহ্ন


রাজধানী ঢাকার রাস্তায় এখনও প্রায় ৭০ লাখের বেশি অবৈধ ইলেকট্রিক থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক) চলাচল করছে। এই যানবাহনগুলো অনুমোদন ছাড়াই চলছে এবং দেশের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বছরে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে, যা রাষ্ট্রের জন্য বড় ক্ষতি। এই অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ‘বাঘ’ এখনও সড়কে নামতে পারেনি। ‘বাঘ ইকো মোটরস লিমিটেড’-এর তৈরি এই যানবাহনটি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কেন্দ্রীয় অনুমোদন পেলেও জেলা পর্যায়ে রেজিস্ট্রেশন না দেওয়ায় প্রকল্পটি দীর্ঘদিন আটকে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট কাজী জসিমুল ইসলাম বাপ্পি অভিযোগ করেন, অবৈধ ইজিবাইকগুলো অবাধে চললেও বৈধ ‘বাঘ’-কে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সরকারের নীতিগত সমর্থন ছাড়া দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি এই বাহনকে রাস্তায় নামানো সম্ভব হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের সংকট গভীর। সিসা দূষণ, ডিজেল-চালিত যানবাহনের ধোঁয়া, কার্বন নিঃসরণ, অবৈধ ইজিবাইক-সব মিলিয়ে জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তারা বলছেন, পরিবেশবান্ধব বৈধ ‘বাঘ’ সড়কে নামালে রাজধানী ও দেশের জন্য টেকসই, নিরাপদ ও লাভজনক সমাধান তৈরি হবে। কিন্তু জেলা বিআরটিএ’র অসহযোগিতা, শুল্ক-ডিউটি জটিলতা এবং সরকারের আন্তরিকতার অভাব এখনও এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। তারা মনে করছেন, এখনই বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, নয়তো স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশদূষণ ক্রমশ বাড়বে এবং দেশের বৈদেশিক রাজস্ব ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নষ্ট হবে। ২০১৮ সাল থেকে ‘বাঘ’ চালুর উদ্যোগ নেন উদ্যোক্তা বাপ্পি। বুয়েটসহ বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ৪২ মাসের প্রচেষ্টার পর ২০২২ সালের মার্চে বিআরটিএ কেন্দ্রীয়ভাবে রেজিস্ট্রেশন দেয়। কিন্তু এরপরও জেলা পর্যায়ে রোড ট্রান্সপোর্ট কমিটির (আরটিসি) অনুমতি না পাওয়ায় গাড়ি চালু করা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, সোলার চার্জিং সিস্টেম। সোয়াপেবল লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। জিপিএস ও ওয়াইফাই সংযোগ। ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা। মোবাইল ব্যাংকিং পেমেন্ট সুবিধা। ৭ জন যাত্রী বহনের ক্ষমতা। উন্নতমানের ইস্পাত ব্যবহারের কারণে দীর্ঘস্থায়ী এবং নিরাপদ। প্রতি কিলোমিটার চলবে মাত্র ৪০-৪৫ পয়সায়। একবার চার্জে চলবে ১২০ কিলোমিটার এবং সৌরবিদ্যুতে বাড়তি ২৫-৩০ কিলোমিটার। উদ্যোক্তা বাপ্পি জানান, যদি ‘বাঘ’ সড়কে নামানো হয়, রাজধানীর যাত্রীরা সাশ্রয়ী ভাড়া ও নিরাপদ যাতায়াত করতে পাবেন। সরকার প্রতিবছর অন্তত ১০-১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে পারবে। পাশাপাশি কার্বন ক্রেডিট সুবিধা থেকে আন্তর্জাতিক অর্থায়নও সম্ভব। রাজধানীর রাস্তায় এখনও প্রায় ৭০ লাখ অবৈধ ইলেকট্রিক থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক) চলাচল করছে অনুমোদন ছাড়াই। এই যানবাহনগুলো প্রতি বছর প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ চুরি করছে এবং শহরের বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমবর্ধমান। বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, ৩৯ হাজার ১৬৯টি পুরনো বাস ও মিনিবাস ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে এসব যানবাহনের কারণে ৩০৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯৪৩ জন নিহত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি-র সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকার ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় সিসা পাওয়া গেছে। ব্যাটারি পুনঃপ্রক্রিয়াজাত কারখানা ও সিসা নির্গমনকারী শিল্পাঞ্চলের আশপাশে বসবাসকারী শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা অন্যদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে, সিসার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত করে, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৫ সালের হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট স্কোরকার্ড অনুযায়ী, বাংলাদেশের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সূচক মাত্র ৪২ (১০০-এর মধ্যে)। পিএম২.৫ কণার ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত সীমার ১৬ গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যদি অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে শিশু ও কর্মজীবী জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমশ বাড়তে থাকবে। সরকার সেন্টমার্টিনের পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য লোকজনের যাতায়াত সীমিত করতে পারে, কিন্তু ঢাকা শহরের কোটি কোটি মানুষকে দূষিত বায়ু ও সিসার ঝুঁকিতে ফেলে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ সংকট এখন গভীর এবং এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি। ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় ‘বাঘ ইকো মোটরস লিমিটেড’-এর পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক থ্রি-হুইলার ‘বাঘ’ একটি কার্যকর সমাধান। নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত তাদের কারখানায় প্রতিদিন ৩ হাজার ‘বাঘ’ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। ইতোমধ্যে ভারত, কম্বোডিয়া, সুদান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইথিওপিয়ায় রফতানির আলোচনা চলছে। ২০১৮ সালে ‘বাঘ’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও জেলা বিআরটিএ অফিসের অসহযোগিতা এবং বিভিন্ন অদৃশ্য প্রক্রিয়ার কারণে গাড়িটি সড়কে নামানো সম্ভব হয়নি। কাজী জসিমুল ইসলাম বাপ্পি অভিযোগ করেন, আমরা বুয়েটসহ বিভিন্ন মানসম্পন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়েছি। তবু জেলা বিআরটিএ অফিস থেকে অনুমতি মিলছে না। অথচ হাজার হাজার অবৈধ যানবাহন প্রতিদিন শহরজুড়ে চলাচল করছে। তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, এনবিআরের শুল্ক কাঠামোও ‘বাঘ’ এবং অন্যান্য ইভি প্রকল্পের পথে বড় বাধা। বৈদ্যুতিক বাস ও থ্রি-হুইলারে শুল্ক ৪০-৬০ শতাংশ, যেখানে ডিজেল বাসে মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুল্ক ও ডিউটি সহজ করা হলে দেশীয় প্রযুক্তির বাঘ দ্রুত সড়কে নামানো সম্ভব। এতে দেশের রাজস্ব, আন্তর্জাতিক কার্বন ক্রেডিট এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে। ঢাকার পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ প্রায়শই সীমিত। বিশেষজ্ঞরা দেখাচ্ছেন, সরকার কোনও বাস্তব উদ্যোগ ছাড়াই সেন্টমার্টিনের মতো ছোট জায়গা সংরক্ষণের দিকে মনোযোগ দেয়, কিন্তু রাজধানীর লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে আন্তরিক নয়।
বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক মনে করেন, ডিজেলচালিত বাণিজ্যিক যানবাহনই সবচেয়ে বেশি দূষণ তৈরি করছে, অথচ এগুলো এখনও উৎসাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশ এখনও ইভি গ্রহণে আন্তরিক নয়। তিনি বলেন, চীন, ভিয়েতনাম ইভিকে জাতীয় অগ্রাধিকারে তুলেছে। বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে। শুল্ক কাঠামো এবং নীতিগত সমর্থনের অভাবে উদ্যোক্তারা ইভি আমদানি বা উৎপাদনে নিরুৎসাহিত। তিনি আরও বলেন, দেশীয় শিল্পও প্রস্তুত। বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ইতোমধ্যে একাধিক লাইট কমার্শিয়াল ইভি মডেল তৈরি করেছে এবং সারা দেশে চার্জিং নেটওয়ার্ক গড়ার পরিকল্পনা করছে। ‘বাঘ’ সড়কে নামলে বিদ্যুৎ খরচ ও ভাড়া সাশ্রয় হবে। প্রতিবছর ১০-১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। কার্বন ক্রেডিট ও আন্তর্জাতিক ফান্ড থেকে আয় হবে। রাজধানীর শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে। দেশের পরিবেশ উন্নত হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব হ্রাস পাবে। ঢাকা শহরে ৪০০টি বৈদ্যুতিক বাস নামানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই বছরের মধ্যে এই বাসগুলো চালু হওয়ায় কথা। প্রথম ধাপে দুটি চার্জিং ডিপো হবে পূর্বাচল ও কাঁচপুরে। বাসগুলো রাজধানীর দুই-তিনটি রুটে চলবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ